গরু পাচার ও মাদকের ব্যবসা রমরমা – শেখ জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট থেকে : লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে অবৈধপথে দেদার আসছে ভারতীয় গরু, মহিষ, ফেনসিডিল, গাঁজা, মদসহ নানা অবৈধ পণ্য। চোরাকারবারিরা এতটাই বেপরোয়া রাত হলেই হৈই হৈই রই রই করে মিছিলের মতো করে সীমান্তে গিয়ে চোরাই পণ্য নিয়ে আসে। কৌশলগত কারণে চোরাকারবারিরা একসঙ্গে ৮-১০টি কোটার মানুষ সীমান্তে যায়।
প্রতিটি কোটায় থাকে ৪০-৫০ জন। কোনোভাবেই থামছে না সীমান্তে চোরাচালানি। এ নিয়ে বিজিবির উচ্চ মহলে গোয়েন্দা রিপোর্ট হয়েছে। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে লোক দেখানো লোকালয়ে অভিযানে নেমেছে বিজিবি। সীমান্তে বসবাসরত মানুষ বলছে, রাতে সীমান্ত খোলা রেখে দিনে লোকালয়ে অভিযান করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে।
লালমনিরহাট সীমান্তে গরু পাচার ও মাদকের ব্যবসা রমরমা
সীমান্তবর্তী গ্রাম সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলার প্রায় ২৪৭ কিলোমিটার ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্ত প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করছে লালমনিরহাট ১৫ বিজিবি, রংপুর ৫১ বিজিবি ও রংপুর ৬১ বিজিবি তিস্তা-টু। একসময় সাবেক বিডিআর (বর্তমান বিজিবির) সেক্টর পরিবর্তন হলে একসঙ্গে সব সদস্য কর্মকর্তাসহ সেক্টরের বদলি হতো। এখন তা হয় না।
এখন সেক্টর থাকেন কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং সৈনিকদের পরিবর্তন হয়। যার কারণে অনেক সদস্য দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তে ঘুরেফিরে কাজ করছেন। তাদের নিজস্ব বলয় তৈরি হয়েছে। তারা সীমান্তে গঠে তুলেছেন সিন্ডিকেট। এসব ‘র’ সিন্ডিকেট গড়ে সীমান্তে চলছে অবৈধ ব্যবসা।

জানা গেছে সীমান্তের তিনটি সেক্টরের অধীনে থাকা কমপক্ষে ৪০টি পয়েন্ট দিয়ে দেদার আসছে ভারতীয় গরু, মহিষ, ফেনসিডিল, গাঁজা, মদ, ওষুধ, থ্রি-পিচ, শাড়িকাপড় ইত্যাদি অবৈধপণ্য।
সীমান্ত গ্রামের স্কুলশিক্ষক মো. মুকুল মিয়া বলেন, প্রতিদিন সীমান্তে শহর থেকে শত শত মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস, থ্রি-হুইলারসহ নানা যানবাহনে চেপে তরুণ, যুবা, কিশোর, যুবতীরা ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবা, মদ, সেবন করতে আসছে। প্রশাসনের লোকজন বিষয়টি অবগত কিন্তু কোনো প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেই। আবার রাত হলে সীমান্তের নোম্যানসল্যান্ড চোরাচালানির দখলে চলে যায়। রাতে বিজিবির সদস্যরা রাস্তায় টহল দেয় কিন্তু সীমান্তে একসঙ্গে ৮-১০টি কোটার দল বাঁশের কপিকল লাগিয়ে মূহূর্তে কয়েকশ গরু পার করে নিয়ে আসছে।
গরুর সঙ্গে চলে মাদক, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের অবৈধ পণ্য পাচার। সীমান্তে যেসব জায়গা দিয়ে অবৈধভাবে গরু ও মাদক এবং অবৈধ নানা পণ্য আসছে সেগুলো হচ্ছে পাটগ্রামের জোংরা, জগৎবের, নাজির গোমানি, বুড়িমারী, সানিয়াগান, হাতীবান্ধার ভুটিমঙ্গল, বড়খাতা, গোতামারী, দৈই খাওয়া, জাওরানি, বনচৌকি, ভেলাগুড়ি, পূর্বকদমা, কালীগঞ্জের শিয়ালখাওয়া, গোড়ল, চন্দ্রপুর, চামটা, চাপারহাট, আদিতমারীর দুর্গাপুর, ভেলাবাড়ী, মোগলহাট, চওড়াটারী, সদরের কুলাঘাট, শীবেরকুটি, মোগলহাট, শালমারী, ফলিমারীর চর প্রভৃতি।
চাপারহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মিটিংয়ে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছি মাদক ও গরু পাচার নিয়ে। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। বরং এসব জনকল্যাণমূলক কাজ করায় একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে নানা রাজনৈতিক ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। মিথ্যা মামলা তো রয়েছেই।

তিনি জানান, মোগলহাট ও কুলাঘাট ইউনিয়নের সীমান্তে ধরলা নদীর চরাঞ্চলে ভারতীয় মহিষ পাচার হয়ে আসছে। সেখানে একটি চক্র গড়ে উঠেছে। এমনকি বিজিবির কুলাঘাট বিশেষ ক্যাম্পের কিছু অসৎ সদস্যও জানে। তারা স্পট অভিযান করে কোনো সাফল্য দেখায় না। রহস্যজনক কারণে এমনটি হয়ে থাকে।
অভিযোগ রয়েছে, সীমান্ত গ্রামের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে চোরাচালানিকে সহায়তা করে থাকে। বিশেষ করে চৌকিদার, দফাদার ও গ্রামপুলিশরা। তারাও চোরাচালানিদের হয়ে কাজ করে। ভেলাবাড়ী ও গোড়ল ইউনিয়নে এমন ঘটনায় গ্রামপুলিশকে আটক করে থানায় সোপর্দের ঘটনাও ঘটেছে।
বিজিবি বলছে, তারা সাধ্যমতো সীমান্ত প্রতিরক্ষায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে সীমান্তে এখনো তেমন সুযোগ-সুবিধা গড়ে উঠেনি বিজিবির জন্য। এখনো সীমান্তে বিজিবির বিওপি টু বিওপিতে দ্রুত যোগাযোগের রাস্তা গড়ে উঠেনি। তারপরেও গত ৭ দিনে ৪৪ লাখ টাকার অবৈধ পণ্য আটক করেছে বিজিবি। গত বৃহস্পতিবার রাতে লালমনিরহাট ১৫ বিজিবির পক্ষে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়। ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ দিনে চোরাই পণ্য ও মাদক উদ্ধারের এই সফলতা।
লালমনিরহাট ব্যাটালিয়নের (১৫ বিজিবি) ঝাউরানী, দিঘলটারী, গোড়কমন্ডল, কুলাঘাট বিশেষ ক্যাম্প, রামখানা ও অনন্তপুর বিওপির আওতাধীন সীমান্ত থেকে ২৫৫ বোতল ভারতীয় ফেনসিডিল, ৫৭ বোতল ভারতীয় ইস্কাপ সিরাপ, ১ বোতল ভারতীয় মদ ও ৩১ কেজি গাঁজাসহ ২ জনকে আটক করা হয়েছে।
কুলাঘাট বিশেষ ক্যাম্প ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ভারতীয় শাড়ি, থ্রিপিস, প্যান্টের থান কাপড় ও ভারতীয় প্রসাধনী সামগ্রী এবং কাশিপুর ও অনন্তপুর বিওপির সীমান্ত থেকে ১০ হাজার টাকা মূল্যের ৭৪ দশমিক ৫ কেজি ভারতীয় চিনি, বালারহাট বিওপির সীমান্ত থেকে ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ১টি ভারতীয় গরু, দিঘলটারী ও অনন্তপুর বিওপির সীমান্ত থেকে এক লক্ষ এক হাজার টাকা মূল্যের ভারতীয় জিরা ও ধান আটক করা হয়েছে।

লালমনিরহাট ব্যাটালিয়ন (১৫ বিজিবি)-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহ মো. শাকিল আলম বলেন, মাদকদ্রব্য ও চোরাচালানি মালামাল উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তে নানা সীমাবদ্ধতার কথাও তিনি স্বীকার করেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশঙ্খলা রক্ষায়ও বিজিবির বিশালসংখ্যক সদস্য কাজ করছে। তার পরেও সীমান্তে মাদক পাচার ও চোরাচালান বন্ধে বিজিবি কঠোর অবস্থানে আছে। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
আরও পড়ুন :